একবার তো ইজ্জতের ওপর দিয়ে গেছে, এবার যাবে জীবন। আমরা কি আর এই শহরে থাকতে পারব? - SaraBela Net Media

Breaking

4G-1010-X-90
English বাংলা

Post Top Ad

Post Top Ad

4G-970-X-90

Tuesday, August 1, 2017

একবার তো ইজ্জতের ওপর দিয়ে গেছে, এবার যাবে জীবন। আমরা কি আর এই শহরে থাকতে পারব?

আমরা কি আর এই শহরে থাকতে পারব? একবার তো ইজ্জতের ওপর দিয়ে গেছে, এবার যাবে জীবন। 

এখন তো আপনারা আছেন, পুলিশও আসছে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমরা কি আর এই শহরে থাকতে পারব? একবার তো ইজ্জতের ওপর দিয়ে গেছে, এবার যাবে জীবন। আসলে গরিব মানুষের কোথাও জায়গা নাই।’

বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় বসে কথাগুলো বলতে বলতে মাথা নিচু করে ওড়না দিয়ে চোখ মুছছিল ধর্ষণের শিকার মেয়েটি। আক্ষেপ করে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে সে বলে, ‘কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে আমি মানুষের জন্য রাস্তায় দাঁড়াইছি। মানববন্ধন করেছি, সমাবেশ করেছি। এখন আমার জন্য মানুষ এসব করছে। ইজ্জত গেল, অনেক শখের চুল ছিল মাথায়, তা-ও গেল। আমার জীবনের আর থাকল কী?’

মেয়েটির মা এ সময় পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। নির্যাতনের পর দুজনেরই মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে তুফানের সহযোগীরা। ওড়নায় ঢাকা মেয়ের মাথার দিকে তাকিয়ে মা 
বললেন, ‘মারধরের পর তুফানের বউ আমার বেটির চুল টেনে ধরে বলল, “তোর মাথায় ম্যালা চুল। এই চুল দিয়া তুফানেক পাগলা করচু? দাঁড়া, তোর চুল কাটমু।” বলেই চুল কাটা শুরু করে দিল। মেয়েটা কতবার হাতে পায়ে ধরল। কিছুই শুনল না।’

মায়ের কথা আর শেষ হয় না। বলেই যাচ্ছেন, ‘তুফানের লোক আতিক বাড়ির সামনে পিকআপ নিয়ে আইলো। বললো, ৩০ মিনিটের মধ্যে মালপত্র নিয়া বগুড়া ছাড়। আর কোনো দিন যেন বোগড়াতে না দেখি। পরে তুফানের ভাই জাহাঙ্গীর আইসা বলল, ঠিক আছে ৩০ মিনিট না, দুই দিন থাকতে পারবু, তারপর যাবু।’

বগুড়ার শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার ১৭ জুলাই মেয়েটিকে তাঁর ক্যাডার দিয়ে বাসায় তুলে নিয়ে ধর্ষণ ও নির্যাতন করেন। তুফানের স্ত্রী তখন বাড়িতে ছিলেন না। পরে মেয়েটিকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সহযোগী আতিকুর রহমানের সঙ্গে তার বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

গতকাল সোমবার হাসপাতালে মা-মেয়ের সঙ্গে প্রথম আলো প্রতিবেদকের কথা হয়। দুদিন থেকেই হাসপাতালের ওয়ার্ডে বেশ জটলা। জেলা পুলিশ পাহারা বসিয়েছে। চিকিৎসক-নার্সের ভিড়। ঘন ঘন সাংবাদিকেরা আসছেন, আসছেন এলাকার মানুষ। রাজনৈতিক দলের নেতারাও আসছেন। সকালে আসেন বগুড়া-১ আসনের সাংসদ আবদুল মান্নান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এই পরিবারের ওপর যা হয়েছে তা অমানবিক। এসব খারাপ লোকের দায় দল নেবে না। এদের বিচার হবেই।

সাংসদের সঙ্গে ছিলেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মাসুদ আহসান। তিনি বললেন, ‘মা-মেয়ে হাসপাতালে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যা যা করার ছিল করেছি।’ সার্জারি বিভাগের প্রধান আবদুল মোত্তালিব হোসেন বলেন, মেয়েটিকে অনেক মারধর করা হয়েছে। শরীরের সাত-আট জায়গায় দাগ আছে। মেয়েটা এখনো ট্রমায় আছে। এটা কাটতে সময় লাগবে।

মেয়েটি আরও বলল, ‘মারধরের পরও আমি তো ভয়ে কাউকে কিছু বলিনি। তুফানের বউ আশা এসএমএস করে বলেছে, “তোর জন্য আমার স্বামীর যদি কিছু হয় মাডার করে জেল খাটমু।” হাসপাতালে আসার পর ডাক্তার সব শুনলেন, এরপর পুলিশ এল। আমি বললাম, আমার কিছু হয়নি। কিন্তু পুলিশ বলল, “ভয় নাই সব খুলে বলো আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।” এরপর সব বলি।’

মেয়েটির মা জানান, তাঁর আর সন্তান নেই। স্বামী ছোট ব্যবসা করেন। একমাত্র মেয়েটি এবার এসএসসি পাস করল। ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগ হয়নি। তিনি ১০-১২ দিন আগে মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় যান। হঠাৎ শুনতে পান বগুড়ায় তাঁর বাড়িতে কাউন্সিলর মার্জিয়া আক্তারের লোক আতিক, মুন্না, দিপু, পারভেজ এসে তালা দিয়েছে। এর কারণ তিনি প্রথমে বুঝতে পারেননি। কারণ, ১৭ জুলাই ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও প্রাণ ভয়ে মেয়ে তা প্রকাশ করেনি। ঢাকাথেকে গত বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) বাড়ি এসে দেখেন, ঘরে তালা। সেদিন তিনি অন্যের বাড়িতে থাকেন। পরদিন শুক্রবার দুপুরে মা-মেয়ে যান কাউন্সিলর মার্জিয়া আক্তারের বাসায়। মার্জিয়া তুফানের স্ত্রী আশার বোন। মেয়েটির মা বলেন, ‘কাউন্সিলর আমাদের দেখেই জ্বলে ওঠে। মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েই লাঠি দিয়ে মারধর শুরু করে। ফোন করে তুফানের লোকজনকে ডেকে আনে। ওরা এসে আবার আমাদের অনেক মারধর করে। তুফানের বউ একটা কাঁচি নিয়ে এসে প্রথমে মেয়ের মাথার চুল কেটে দেয়। এরপর আমার চুল কেটে দেয়। তুফানের লোক আতিক ও মুন্না এসে বলে, এভাবে হবে না। নাপিত ডাকো। এরপর নাপিত এসে আমার ও মেয়ের চুল কেটে ন্যাড়া করে দেয়। মারধর ও চুল কাটার পর পাহারা দিয়ে তারা আমাদের বাসায় নিয়ে আসে। আতিক বাসার তালা খুলে দিয়ে বলে, বাইরে পিকআপ রেডি আছে। সব মালপত্র নিয়ে ৩০ মিনিটের মধ্যে বগুড়া ছেড়ে চলে যাও। পরে তুফানের ভাই এসে দুই দিন থাকার সুযোগ দেয়।’

 মা আরও বলেন, বাসায় এসে মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন প্রতিবেশী মুরগি বিক্রেতা রুবেল হোসেন এগিয়ে আসেন। তিনি মেয়েকে হাসপাতালে নিতে বলেন। শুক্রবার রাতেই তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি হন।

গতকাল দুপুরে রুবেল হোসেনের খোঁজে তাঁর চকসূত্রাপুরের বেগম বাজারের বাসায় গেলে তাঁর ছেলে তামিম জানায়, ওই মেয়েটি ও তারা এক বাড়িতেই থাকে। কাউন্সিলরের লোকজন তালা দেওয়ার পর তারাও ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। বাড়িটি আট দিন তালাবদ্ধ ছিল।

এলাকার লোকজন বলেছেন, তুফানের ভাই মতিন সরকার বগুড়া জেলা ট্রাক মালিক সমিতির নেতা। তুফানের সব অপকর্মের নেপথ্যে এই ভাই। তুফানের চামড়া গুদাম লেনের বাসায় গেলে কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হননি। বাড়িটি তালা দেওয়া। পাশেই তুফানের ভাই মতিন সরকারের বাড়ি। দুপুরে দিকে তিনি বাড়িতে থাকলেও সাংবাদিক পরিচয় শুনে আর কথা বলেননি।

হাসপাতালে আসার পর কোনো হুমকি এসেছিল কি না জানতে চাইলে মেয়েটির মা বলেন, ‘শুক্রবার রাতেই হাসপাতালে লোক পাঠিয়েছিল তুফান। আমাকে বলেছে, “মামলা তুলে নাও, মেয়েকে বিয়ে করবে তুফান।” না হলে নাকি আমাদের অনেক ক্ষতি হবে।’

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad